অদ্ভুত রহস্যের… ‘বুকভরা বাওড়’ (জাকির আবদার)

শুরু থেকে আজ অবদি একবারের জন্যেও এর বুক পানি শুন্য হয়নি।আর এর সৃস্টি যে কোন কালে হয়েছিল তা সবারই অজানা।আমার অনেকবারই জানতে ইচ্ছে
হয়েছে এর উৎপত্তি ও এই বাওড়কে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা সম্পর্কে।পরিচিত অনেক বয়স্ক লোকের রাতের ঘুম হারাম করে শুনেছি তাদের দেখা,শোনা,ও জানা কাহিনী।।এই বাওড় থেকে একটি খাল কপোতাক্ষ নদে গিয়ে মিশেছে।মহাকবি মাইকেল মধুসূদন বিখ্যাত হয়েছিলেন  যে নদকে নিয়ে কবিতা লিখে।আমি বিখ্যাত হওয়ার জন্যে নই,আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর ও রহস্যময় একটি স্থান সম্পর্কে শুধু আপনাদেরকে অবহিত করতে চাই।

মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শ্ত্রুমুক্ত জেলা যশোর।এই সহর থেকে পশ্চিমে বীরশ্রেস্ট নূর মুহাম্মদ সড়ক ধরে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে গিয়েই; চোখে পড়ে হাজার বছরের সাক্ষী,প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর এক অপরুপ চিত্রের উন্মুক্ত প্রদর্শনী।যার নাম ‘বুকভরা বাঁওড়’।
দক্ষিণে হালসা,পশ্চিমে আরিচপুর,উত্তরে চান্দুটিয়া এবং পূর্বে মঠবাড়ি ও ইছাপুর।এই পাঁচ গ্রামকে স্পর্শ করে আছে বাওড়।স্পর্শ করে আছে এখানকার প্রতিটি মানুষের হৃদয়।ভক্তিতে,বিশ্বাসে বারবার স্মরনে আসে হাজারও কল্প-কাহিনীর জনক এই বুকভরা বাওড়ের নাম।বহুযুগ ধরে মানুষ বাওড়কে সাক্ষী রেখে আল্লাহর দরবারে মনঃ বাসনা পূরনের দাবি জানায়।

কানুঘোসের ইচ্ছেই তা পূরণও হয়।নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে কে এই কানুঘোষ? কানুঘোষ বাষ করে বাওড়ের মধ্যে পানির নীচে।তাও আবার একা নয়;স্বপরিবারে।কানু ঘোষের আছে গোয়াল ভরা গরু।এ যেন এক রুপ কথার গল্প।

 এক সময় কোনো মেয়ে- ছেলের বিয়েতে কানুঘোষকে দাওয়াত দিয়ে আসার পর, তিনি নাকি সোনার থালা-বাশন দিয়ে অতিথি সৎকারে সাহায্য করতেন।বিয়ে শেষ হলে এগুলো আবার ফেরত নিতেন কানুঘোষ।কোনো এক লোভী নারী একটি সোনার চামুস লুকিয়ে রেখেছিল।সেই থেকে আর কানুঘোষ মানুষের দাওয়াত গ্রহন করেন না।
কথায় বলে ‘বিশ্বাষে মেলায় বস্তু’।আজো মানুষ তাই প্রেমে সফলতা পেতে,কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পেতে,পরীক্ষায় ভাল ফল পেতে,পারিবারিক সুখ-শান্তি ফিরে পেতে বাওড়ে মান্নত করে।কেউ কেউ ফলও পাই।অতএব ধরে নেওয়া যায় যে,কানুঘোষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন কিন্তু নির্দয় হয়নি।

সাদা মাছের জন্য বিখ্যাত এই বুকভরা বাঁওড়ে মাছ ধরতে আসা মৎস্য শিকারীদেরকে সহজে বৈমুখ করেন না কানুঘোষ।কিন্তু যারা চ্যালেঞ্জ করে মাছ ধরতে নামে তারা ঠিকই ব্যার্থ হয়ে ঘরে ফিরে যায়।অনেকে দূর্ঘটনার স্বীকার হয়।একবারতো একজন পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার একসপ্তাহ পর তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল।এক সপ্তাহ পর পাওয়া লাশ এতটাই টাটকা ছিল যে,সবার ধারনা হচ্ছিল এই মাত্র মারা গেছে লোকটি।

এবার একটু অন্য প্রসংগে যাওয়া যাক।তিন শত বাষট্টি গ্রামের পানি আসে এই বাঁওড়ে।যে পানি বাঁওড় থেকে একটি মাত্র খাল দ্বারা কপোতাক্ষে গিয়ে মিশে।কিন্তু কখনো উপছে পড়ে না।আবার কপোতাক্ষের পানি এই খাল বেয়ে আসেনা।এর অবশ্য একটা কারন আছে।একসময় গাজি,কালু,চম্পাবতির আগমন ঘটে দক্ষিণবঙ্গে ।আস্তানা গাড়েন যশোর শহরের অদূরে লাউজানী নামক স্থানে।বর্তমানে গাজির দর্গা নামে একটি এতীমখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এখানে।

যাহোক,গাজী পীর একদিন নামাজ আদায় করছিলেন এই খালের পাড়ে।বন্যার পানি উল্টা শ্রোতে কপোতাক্ষ থেকে বুকভরার দিকে চাপ দেই।অত্র অঞ্চলের লোক জনের কষ্টের কথা ভেবে পীর তার হাতের লাঠি দিয়ে পানিকে ঈশারা করেন।সাথে সাথে পানির শ্রোত বন্ধ হয়ে যায়।পীরের কল্যানে আজো এই অঞ্চলের লোকজনকে বন্যার মতো মহাদূর্যোগের স্বীকার হোতে হয়না।

বাঁওড় ছেঁড়ে খালের গল্পে চলে আসার জন্যে দুঃক্ষিত!এটা অবশ্য সত্যি যে বুকভরা বাঁওড়ের গল্প শুধু খাল বেয়ে নয়;মানুষের হৃদয় বেয়ে চলে গেছে দেশ হোতে দেশান্তরে।কত জনে কবিতা লিখেছেন,কতজনে প্রবন্ধ,উপন্যাস লিখেছেন।কতজনে গানও লিখেছেন এই বাঁওড়কে ঘিরে।সত্যি কথা বলতে কি আমিও বিভিন্ন সময়ে গান,কবিতা লিখেছি প্রিয় বুকভরাকে কেন্দ্র করেঃ-
                  ও বন্ধুয়ারে ঘুরতে এসো বুকভরা বাঁওড়ে-
     তোমার বিরহী মন সুখের ছোয়ায় যাবে জানি ভরে।
                   সুখের হাওয়া ব’য় এখানে সারা বছর ধরে-
                                       সুখের হাওয়া ব’য় এখানে সারা বছর ধরে।

সত্যিই মন ভাল করার যুগান্তকারী এক আবিস্কার এই বুকভরা বাওড়।সব মৌসূমেই সমান সৌন্দর্য্য বিরাজমান।শত ব্যাথার পাহাড় বুকে ধরেও যখন বাঁওড়ের সামনে গিয়ে দাড়াই! একনিমিশেই সব ব্যাথা পালিয়ে যায়।বাঁওড় আমাকে বলে;তিন শত বাষট্টি গ্রামের লোকের কান্নার জল আমার বুকে ধারন করেছি।আবার এই কান্নার জলের মাঝেই ফুটিয়েছি শাপলার হাসি।অদ্ভুত তাইনা?
অদ্ভুত কথাটি আসতেই জিন,ভুতের যে ব্যাপার-স্যাপার আছে বাঁওড়ে তা মনে পড়ে গেল। বাঁওড়ের আসে-পাশে হিন্দু সম্প্রদায়ের যে সব লোকজনের বাস তাদের কেউ মিত্যু বরণ করলে বাঁওড় ঘাটেই তাকে পোড়ানো হয়।অনেকের বিশ্বাস খারাপ লোক মিত্যুর পর তাদের আত্না ঘুরে বেড়াই আমাদের আসেপাশে।গভীর রাতে মাছ ধরতে গিয়ে অনেকে নাকি দেখেছে মৃত মানুষকে হেটে বেড়াতে।ঘাড় মটকে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে অনেককে বাধ্য করেছে বাঁওড় থেকে বাড়ি ফিরে যেতে। আম্যাবস্যা- পূর্নিমার সময় গভীর রাতে কেউ ভুল করেও বাঁওড় ঘাটে যায়না।কারন এই রাতে মৃতের আত্নারা উৎসবে মেতে থাকে।পূর্বে মানুষ দূর থেকে এই উৎসবের বাদ্য-বাজনা শুণে অনুমান করতেন।এখন বাদ্য-বাজনার আওয়াজ শোনা না গেলেও বাতাসে ভেসে আসে অদ্ভুত হাসির শব্দ।যা খুব সহজেই মানুষকে ভয় পাইয়ে দেই।

বুক ভরা বাঁওড়ের শশ্মান ঘাটে বালিশ ভর্তি টাকা পেয়ে ধনী হওয়ার গল্প ছাড়াও অসংখ্য গল্প আছে ।যা বলে শেষ করা যাবে না।তাই আজ এই পর্যন্তই রাখছি।আবারও বুকভরা বাওড়ের মন ভরা সব গল্প নিয়ে আসব।সাহিত্য চর্চায় বিশেষ পটু না হওয়ায়; লেখায় ভুল থাকতে পারে।আপনাদের সহযোগীতা পেলে আস্তে ধীরে ভুলগুলো শুধরে নিতে পারব।আশা করি পাশে থাকবেন।ধন্যবাদ।
Previous
Next Post »

1 comments:

Write comments
Unknown
AUTHOR
৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ এ ৮:৩০ AM delete

অনেক কিছু জানতে পারলাম

Reply
avatar